শত শত সিরাত পড়তে কার না মন চায়! মন তো চায়, রাসুলের যত জীবনী আছে, সব আমার পড়া থাক। কিন্তু মন চাইলেও জীবন ও জীবিকার চাপে আমরা অনেক কিছুই পড়ি না। অনেক কিছু মাটির মানুষের পক্ষে সম্ভবও না।
বিশ্ব জুড়ে চলছে সিরাতের নানামুখী কাজ। সে ধারাবাহিকতায় একটি সিরাত যদি এমন পাওয়া যায়, যেটি অনেক সিরাতের মূল স্বর ও সুরকে ধারণ করছে, তাহলে কেমন হয়!
ড. শায়খ আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি রচিত এই সিরাত আপনাকে শত শত সিরাত পাঠের নির্যাস, তথ্য ও অভিজ্ঞান দিতে পারে। সিরাতটি সেভাবেই রচিত। সিরাতটির আরও একটি দিক এই—রাসুলের জীবন-অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করে বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতার সমাধান এতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
মানব-জীবনের শুদ্ধতার মাপকাঠি নবিজির আদর্শ। তাই তাঁর জীবনী বা সিরাত অধ্যয়ন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অতি জরুরি। তাই ড. সাল্লাবি রচিত প্রায় ১৪৫৬ পৃষ্ঠার ৩ খণ্ডের সিরাতুন নবি সা.-এর মতো বহু-বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ সিরাত মুসলিম-মাত্র সংগ্রহে থাকা অতি দরকারি।
লেখক | : | |
---|---|---|
অনুবাদক | : | আবদুর রশীদ তারাপাশী, নুরুযযামান নাহিদ |
সম্পাদক | : | কালান্তর সম্পাদনা পরিষদ |
প্রকাশক | : | কালান্তর প্রকাশনী |
সিরিজ | : | সিরাতুন নবি সা |
কোয়ালিটি | : | হার্ডকভার |
পৃষ্ঠাসংখ্যা | : | 488 |
প্রচ্ছদ | : | মুহারেব মুহাম্মাদ |
প্রকাশকাল | : | মার্চ ২০২০ |
ISBN | : | 978-984-95932-4-9 |
ক্যাটাগরি | : | সিরাত |
রেটিং | : |
Muhaiminul Islam –
আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে আরবের বুকে এসেছিলেন এক মহামানব। এমনই এক সমাজের মাঝে যিনি এসেছিলেন, যেখানে অন্ধকারের রাজত্বে আলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই ছিল দায়। সেই মহামানবই যখন প্রায় পাঁচ যুগ পর তাঁর বন্ধুর সাথে মিলিত হতে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন, ততদিনে সেই আরবভূমি পৃথিবীর বুকে হয়ে উঠেছিল পুরোই আলাদা এক স্থান; যেখান থেকে বিদায় ঘটেছিল বাতিলের, পরাজয় ঘটেছিল মিথ্যার; যেখানে আগমন ঘটেছিল ন্যায়ের, জয়ের আসনে বসেছিল সত্য।
প্রথম অনুচ্ছেদটি পড়েই বুঝে যাবার কথা, এতক্ষণ ধরে যাঁর কথা বলা হলো, তিনি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ব্যতীত আর কেউ নন। এই মহামানবের জীবনী পড়তে গেলে, সেটা যত লেখকেরই পড়া হোক না কেন, প্রতিবারই অবাক ও আবেগাপ্লুত না হয়ে পারা যায় না।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে ভালভাবে জানার জন্য তাঁর উপর রচিত সিরাত বইগুলো পড়বার কোনো বিকল্প নেই। এই জানবার নিয়তেই বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে সংগ্রহ করেছিলাম কালান্তর প্রকাশনী থেকে বের হওয়া বিশ্বখ্যাত ইতিহাস গবেষক ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি রচিত সিরাতগ্রন্থ ‘আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ আরজু ওয়াকায়ি ওয়া তাহ্লিলু আহ্দাস’ এর বাংলায় ভাষান্তরিত সুবিশাল গ্রন্থ ‘সিরাতুন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’।
মাসাধিককাল ধরে তিন খণ্ডের সুবিশাল এই সিরাত বিষয়ক বইটি শেষ করে মনটা একইসাথে আনন্দ আর দুঃখের এক মিশ্র অনুভূতিতে ছেয়ে আছে। আনন্দ এই কারণে যে, এই তিন খণ্ডে এত বিষয়ে এত সুবিস্তৃত পরিসরে আলাপ করা হয়েছে যে তা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে পাঠকের জানার চাহিদা পূরণ করবে নিঃসন্দেহে। দুঃখ এই কারণে যে, মহানবী (সা.)-এর জীবনী সম্পর্কিত যেকোনো বইয়ের শেষের দিকে যখন তাঁর শেষ দিনগুলোর আলোচনা চলে আসে, তখন আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা বেশ কষ্টসাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
তিন খণ্ড মিলিয়ে বইয়ের বিস্তৃতি ১,৫৯৫ পৃষ্ঠা জুড়ে। কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোথাও পাঠক হিসেবে একটুও বিরক্ত হবার অবকাশ নেই। এর পেছনে যেমন মূল লেখকের ভাষাগত সহজবোধ্যতা, পাঠক কী পরিমাণ তথ্য গ্রহণ করতে পারবে সেই বিষয়ে সচেতনতা ও চমৎকার গল্প বলার ঢং কাজ করেছে, তেমনই কাজ করেছে বাংলায় বইটিকে রুপান্তরের কাজে নিয়োজিত অনুবাদক ও সম্পাদনা পরিষদের তিন বছরের নিরলস পরিশ্রমের বিষয়টি। এক্ষেত্রে ‘প্রকাশকের কথা’ অংশে প্রকাশক আবুল কালাম আজাদের কিছু বক্তব্যই পরিশ্রমের মাত্রা বোঝাতে যথেষ্ট, “… অনুবাদ সমাপ্তির পর আরবির সাথে মিলিয়ে দেখতে হয়েছে, একাধিকবার ভাষা সম্পাদনা করতে হয়েছে, বানান বিশুদ্ধতার জন্য বার বার নানাজনের মাধ্যমে রিভিউ করতে হয়েছে। পাঠ সাবলীল করতে কয়েকজন অভিজ্ঞ পাঠককে পড়তে দিয়ে তাদের প্রদত্ত নোটগুলোও আমলে নেওয়া হয়েছে।”
বাংলায় ভাষান্তরিত বইটির বেলায় সবচেয়ে বেশি যেদিকে নজর দেয়া হয়েছে, আমার মতে, তা হলো- গাম্ভীর্য পরিহার করে যথাসম্ভব সহজ, আধুনিক ও প্রচলিত বাংলা ভাষা ব্যবহার করা। আর সর্বোচ্চ সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছাতে যে আসলে এই পদ্ধতি অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই, তা তো না বললেও চলে। মজার বিষয় হলো, বই পড়তে গিয়ে আমার অধিকাংশ সময়ই মনে হয়েছে, ড. সাল্লাবি আসলে লিবিয়ার নাগরিক না, বরং তিনি বাংলাদেশেই জন্ম নেয়া প্রখ্যাত এক ইতিহাস গবেষক, যিনি তার কলমের জাদুতে মোহাবিষ্ট করে রেখেছেন পাঠককে!
আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “কেন আপনি এই বইটি কিনবেন?”, তাহলে আমি বলবো, এই বইয়ে উল্লেখিত ‘শিক্ষা’র জন্য। একটু খোলাসা করেই বলি। হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনের নানা ঘটনা জীবনের নানা পর্যায়ে আমরা শুনেছি বা পড়েছি। সেটা যেমন পাঠ্যপুস্তক হিসেবে, একইভাবে ফেসবুকে কারও স্ট্যাটাসে, মসজিদে ইমাম সাহেবের বক্তব্যে কিংবা ইউটিউবের ভিডিওতেও। তবে এই বইয়ে আমাদের জানা-অজানা-স্বল্প জানা বিভিন্ন ঘটনার যেভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যেভাবে বর্তমান ও অতীতে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে উত্থাপিত নানা প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে, এবং সর্বোপরি বিভিন্ন ঘটনা থেকে বর্তমান মানবসমাজের জন্য (কেবল ‘মুসলিম’ ধর্মাবলম্বীরাই না) কত প্রকার শিক্ষা থাকতে পারে, তা যে লেখক কী বিস্তৃত পরিসরে আলাপ করেছেন, তা আসলে বইটি না পড়লে বোঝার উপায় নেই। আমি বিশেষত এই শিক্ষার কথাটাই বলবো, যা এমন সব ঘটনার বেলাতেও ড. সাল্লাবি আলোচনা করেছেন, যার পেছনে যে আসলে কোনো সূক্ষ্ম ইঙ্গিত ও শিক্ষা লুকিয়ে থাকতে পারে, সেটাই সাধারণভাবে মনে আনা দায়।
বইটির অনন্য আরেকটি বিষয় হলো, এর তথ্যসূত্রের প্রাচুর্যতা। ড. সাল্লাবি নিজেই জানিয়েছেন, “গ্রন্থটিতে শতাধিক তথ্যসূত্র থেকে প্রচুর গবেষণাপ্রসূত ফলাফল এবং প্রায়োগিক চিন্তাধারা একত্র করা হয়েছে।” এই কথাটির মর্মার্থ আপনি কেবল বইটি পড়লেই বুঝতে পারবেন, আমার এই লেখা থেকে না!
এবার আসা যাক উন্নতির জায়গা সংক্রান্ত আলাপে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন দুটো জায়গা খুঁজে পেয়েছি:
১) তিন খণ্ডে সমাপ্ত এই বইটি যে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনের নানা দিক নিয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ একটি রেফারেন্স বই, তা কেউ এটা পড়া শুরু করলেই বুঝতে পারবেন। আর রেফারেন্স দেয়া কিংবা খোঁজার জন্য খুবই কার্যকর বিষয় হলো ‘ইনডেক্স (Index)’ যা বর্ণানুক্রমে বইয়ের একেবারে শেষে সংযুক্ত থাকে। এই বইয়ের তিনটি খণ্ডেও যদি পরবর্তী সংস্করণে প্রতিটি খণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট ইনডেক্স যুক্ত করে দেয়া হয়, তাহলে অনুসন্ধানী ও গবেষণামনস্ক যে কারো জন্য তা হবে খুবই বড় এক পাওয়া।
২) যেকোনো যুদ্ধকে অনুভব করার জন্য, যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি, অবস্থা নিজের মানসপটে সাজিয়ে নেয়ার জন্য সেই যুদ্ধের সময়কার ভূ-প্রকৃতি ও সৈন্য সমাবেশ সংক্রান্ত ম্যাপ খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করা ইংরেজি ভাষার বহু বইয়েই এমন ব্যাটল ম্যাপের দেখা মিলবে। একই ম্যাপ যদি অন্তত হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর বেলায় দেয়া যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে তা পাঠকদের জন্য বিশাল এক পাওয়া হবে। কারণ তখন শুধুমাত্র লিখিত বর্ণনাই না, বরং সচিত্র বর্ণনার জোরে যুদ্ধগুলো আরও জীবন্ত হয়ে ধরা দেবে যেকোনো পাঠকের মনোজগতে।
যদি আপনি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে ভালভাবে জানার জন্য কোনো বইয়ের সন্ধানে থাকেন, তাহলে দ্বিতীয়বার না ভেবেই এই বইটি সংগ্রহ করুন। সমৃদ্ধ হবে আপনার বইয়ের সংগ্রহশালা, আপনার জ্ঞানভাণ্ডার।